১.০ ভূমিকা :
১.১ নদীমাতৃক বাংলাদেশ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই কৃষি প্রধান। কৃষি প্রধান এ দেশের কৃষক তথা আপামর জনসাধারণকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীনের পরেই খাদ্য ঘাটতি দূরীকরণের জন্য জাতির পিতা সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। তাঁর নির্দেশে সংবিধানে কৃষির উন্নতির জন্য নির্দিষ্ট ধারা সংযোজন করা হয়। ফলশ্রুতিতে কৃষি খাতে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। পরবর্তীতে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের কৃষিকে একটি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। তাঁর নির্দেশনা মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশ আজ খাদ্য শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষি তথা অন্যান্য সেক্টর বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
১.২ কৃষি খাতকে একটি সুনির্দিষ্ট নীতির আওতায় পরিচালনার জন্য ১৯৯৯ সালে প্রথম জাতীয় কৃষি নীতি প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে যুগোপযোগী আকারে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উন্নত প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার এবং বালাইনাশকের ব্যবহারে ফসলের ফলন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার যাতে জনস্বাস্থ্য ও কৃষি পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি না করে সে জন্য সচেতন নাগরিক সমাজের মাঝে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের চাহিদা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে নিরিখে জৈব কৃষি (Organic Agriculture) বর্তমান বিশ্বে এক আলোচিত অধ্যায় ও দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে বিবেচিত।
১.৩ উন্নত দেশসমূহে জৈব কৃষি পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে আর সেই চাহিদা পূরণ করতে উন্নয়নশীল দেশে এ চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলিত হচ্ছে এবং সে মোতাবেক জৈব কৃষি নীতিমালা প্রবর্তন করছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭২ টি দেশে জৈব চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলিত আছে; তন্মধ্যে ৮৭ টি দেশে জৈব নীতি ও জৈব মানদণ্ড অনুসরণ করে অর্থাৎ একটা রেগুলেশনের অধীনে জৈব চাষাবাদ প্রচলিত হচ্ছে । উল্লেখ্য, সার্কভুক্ত কয়েকটি দেশসহ পৃথিবীর অনেক অনুন্নত দেশে জৈব কৃষি নীতি বিদ্যমান ।
১.৪ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা ছিল সাধারণ অর্থে জৈব-কৃষির প্রাক-অবস্থা। কালের বিবর্তনে কৃষি-রাসায়নিক ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও জৈব কৃষির প্রথম বিকাশ ঘটে বেসরকারি পর্যায়ে এবং ’৯০ এর দশকের শুরুতে এর বিস্তৃতি লাভ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ হতে চা ও চিংড়ি প্রত্যায়িত জৈব পণ্য হিসেবে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
জাতীয় জৈব কৃষি নীতি – ২০১৬ ১
১.৫ দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কৃষি ও বিশ্ববাণিজ্যে টিকে থাকার নিমিত্ত জৈব কৃষি বিষয়ে প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক :
ক। দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কৃষির জন্য : জাতির পিতার আহ্বানে 'সবুজ বিপ্লবের’ সূচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি থেকে বর্তমানে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। এই স্বয়ম্ভরতা অর্জনে কৃষি-রাসায়নিকের (Agro-chemicals) ব্যবহার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ফলে মাটি ও জনস্বাস্থ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রভাব। এ প্রভাব হ্রাসকরণের অন্যতম উপায় জৈব কৃষি; কেননা এটা মাটি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত বিধায় ক্রমান্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কৃষি সৃষ্টি করতে পারে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একান্ত কাম্য ।
খ। বাণিজ্যের নবদিগন্ত উন্মোচন : বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যে জৈব-কৃষি একটা নতুন অধ্যায় এবং জৈব-কৃষিজাত দ্রব্যের বাণিজ্যিকীকরণ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ জৈব-কৃষিনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ সাপেক্ষে বিশ্ব বাণিজ্যে উদীয়মান এই নব খাতে অংশগ্রহণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। জৈব-মানদণ্ড অনুসরণ করে উৎপন্ন জৈব-কৃষিজাত দ্রব্য বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ামক যা ক্রমবর্ধনশীল ।
গ। বিধি বিধানের আলোকে জৈব পণ্য সংক্রান্ত পরিচালনা : জৈব-কৃষির চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে দেশে অনেক উদ্যোক্তা, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান জৈব-কৃষি দ্রব্যের উৎপাদনে এগিয়ে আসছে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করছে। জৈব কৃষি নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিধি বিধান তৈরি করে সে অনুযায়ী জৈব কৃষি কার্যক্রম পরিচালনা করা একান্ত প্রয়োজন। টেকসই কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও বিশ্ব বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিম্নে উল্লিখিত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু জৈব কৃষিনীতি প্রবর্তন ও প্রচলন করা আবশ্যক।